সূরা ইউসুফ (অর্থ, নামকরণ, শানে নুযূল, পটভূমি ও বিষয়বস্তু)

নাযিল হওয়ার সময়-কাল ও এর কারণসমূহ

এ সূরার বিষয়বস্তু থেকে একথা বুঝা যাচ্ছে যে, এটিও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কায় অবস্থানের শেষ যুগে নাযিল হয়ে থাকবে। তখন কুরাইশের লোকেরা নবীকে (সা) হত্যা বা দেশান্তর করবে, না বন্দী করবে,এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল। এ সময় মক্কার কাফের সমাজের কোন কোন লোক (সম্ভবত ইহুদীদের ইংগিত) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পরীক্ষা করার জন্য তাঁকে প্রশ্ন করে, বনী ইসরাঈলরা কি কারণে মিসরে চলে গিয়েছিল? যেহেতু আরববাসীরা এ ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতো না, তাদের কথা-কাহিনী ও পৌরানিক বৃত্তান্তসমূহে কোথাও এর কোন উল্লেখই পাওয়া যেতো না এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের মুখেও ইতিপূর্বে এ সম্পর্কিত কোন কথা শোনা যায়নি, তাই তারা আশা করছিল, তিনি এর কোন বিস্তারিত জবাব দিতে পারবেন না অথবা এ সময় টালবাহানা করে কোন ইহুদীকে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করবেন এবং এভাবে তাঁর বুজরুকি ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু এ পরীক্ষায় উলটো তারাই মার খেয়ে গেলো। আল্লাহ কেবল সংগে সংগেই ইউসুফ আলাইহি সালামের এ ঘটনা সম্পূর্ণ তাঁর মুখ দিয়ে শুনিয়েই ক্ষান্ত হলেন না বরং এ ঘটনাকে কুরইশরা ইউসুফের ভাইদের মতো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যে ব্যবহার করছিল ঠিক তার সদৃশ ঘটনা হিসেবে উপস্থাপিত করলেন।

নাযিলের উদ্দেশ্য

একঃ এর মাধ্যমে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের প্রমাণ এবং তাও আবার বিরোধীদের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা। এ সংগে তাদের স্থিরীকৃত পরীক্ষায় একথা প্রমাণ করে দেয়া যে, নবী শোনা কথা বলেন না বরং অহীর মাধ্যমে যথার্থ জ্ঞান লাভ করেন। ৩ ও ৭ আয়াতে এ উদ্দেশ্যটি সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে এবং ১০২ ও ১০৩ আয়াতে পূর্ণ শক্তিতে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

দুইঃ কুরাইশ সরদারদের ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে এ সময় যে দ্বন্দ্ব চলছিল তার ওপর ইউসুফ আলাইহিস সালামের ভাইদের ঘটনা প্রয়োগ করে কুরাইশদেরকে একথা জানিয়ে দেয়া যে, আজ তোমরা নিজেদের ভাইয়ের সাথে ঠিক তেমনি আচরণ করছো যেমন ইউসূফের ভাইয়েরা তাঁর সাথে করেছিলেন। কিন্তু যেমন তারা আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে লড়াই করে সফল হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত যাকে চরম নির্দয়ভাবে কূয়ার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো সেই ভায়ের পদতলেই নিজেদের সঁপে দিতে হয়েছিল। ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহর কৌশল ও ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে তোমাদের শক্তি প্রয়োগ সফল হতে পারবে না। একদিন তোমাদেরও নিজেদের এ ভাইয়ের কাছে দয়া ও অনুগ্রহ ভিক্ষা করতে হবে, যাকে আজ তোমরা খতম করে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছো। সূরার শুরুতে এ উদ্দেশ্যটিও পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছেঃ

(আরবী)

“ইউসুফ ও তার ভাইদর ঘটনার মধ্যে এ প্রশ্নকারীদের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে।”

আসলে ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনাকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরাইশদের দ্বন্দের ওপর প্রয়োগ করে কুরআন মজীদ যেন একটি স্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। পরবর্তীকালের ঘটনাবলী তাকে অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণ করেছে। এ সূরাটি নাযিল হওয়ার দেড় দু’বছর পরই কুরাইশরা ইউসুফের ভাইদের মতো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তাদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাবার জন্য তাঁকে বাধ্য হয়ে মক্কা থেকে বের হতে হয়। তারপর তাদের প্রত্যাশার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধেই দেশান্তরী অবস্থায়ই তিনি ঠিক তেমনি উন্নতি ও কর্তৃত্ব লাভ করেন যেমন ইউসুফ আলাইহিস সালাম করেছিলেন। তারপর মক্কা বিজয়ের সময় ঠিক সেই একই ঘটনা ঘটেছিল যা মিসরের রাজধানীতে ইউসুফ আলাইহিস সালামের সামনে তাঁর ভাইদের শেষ উপস্থিতির সময় ঘটেছিল। সেখানে যখন ইউসুফের ভাইয়েরা চরম অসহায় ও দীন হীন অবস্থায় তাঁর সমনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে বলছিলেনঃ

(আরবী)

“আমাদের প্রতি সাদকা করুন। আল্লাহ সাদকাকারীদেরকে উত্তম পুরস্কার দিয়ে থাকেন।”

তখন ইউসুফ আলাইহিস সালাম প্রতিশোধ নেবার শক্তি রাখা সত্ত্বেও তাদেরকে মাফ করে দিলেন এবং বললেনঃ

(আরবী)

“আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দিন। তিনি সকল অনুগ্রহকারীর চাইতে বড় অনুগ্রহকারী।”

অনুরূপভাবে এখানে যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে পরাজিত বিধ্বস্ত কুরাইশরা মাথা নত করে দাঁড়িয়েছিল এবং তিনি তাদের প্রত্যেকটি জুলুমের বদলা নেবার ক্ষমতা রাখতেন তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমরা কি মনে করো, আমি তোমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবো?” তারা জবাব দিলঃ (আরবী) “আপনি একজন উদারচেতা ভাই এবং একজন উদারচেতা ভাইয়ের সন্তান।” একথায় তিনি বললেনঃ

(আরবী)

“আমি তোমাদের সেই একই জবাব দিচ্ছি যে জবাব ইউসুফ তার ভাইদেরকে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। যাও তোমাদের মাফ করে দিলাম।”

বিষয়বস্তু ও আলোচ্য বিষয়

এ দু’টি বিষয় তো এ সূরা উদ্দেশ্যের পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু এ কাহিনীটিকেও কুরআন মজীদ নিছক গল্প বলার ও ইহিতাস লেখার ঢংয়ে বর্ণনা করছে না বরং নিজের রীতি অনুসারে তাকে মূল দাওয়াত প্রচারে ব্যবহার করছে।

এ পুরো ঘটনাটিতে সে একথা সুস্পস্ট করে তুলে ধরছে যে, হযরত ইবরাহীম (আ) হযরত ইসহাক (আ), হযরত ইয়াকুব (আ) সেই একই দীনের অনুসারী ছিলেন যে দীনের অনুসারী ছিলেন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং যে দাওয়াত তিনি দিচ্ছেন সেই একই দাওয়াত তাঁরাও দিতেন।

তাছাড়া সে একদিকে হযরত ইয়াকুব ও হযরত ইউসুফের কর্মকাণ্ড ও চরিত্র এবং অন্যদিকে ইউসুফের ভ্রাতৃবৃন্দ, বণিক দল, আযীযে মিসর, তার স্ত্রী, মিসরের অভিজাত পরিবারের নারী সমাজ ও শাসকদের কর্মকাণ্ড ও চরিত্র পরম্পদের মোকাবিলায় তুলে ধরছে এবং নিছক নিজের বর্ণনাভংগীর মাধ্যমে শ্রোতা ও পাঠকদের সামনে এ নীরব প্রশ্ন উপস্থাপন করছে যে, দেখো, একদিকে ইসলাম একটি আদর্শ চরিত্র পেশ করছে। আল্লাহর বন্দেগী ও আখেরাতে জবাবদিহির প্রতি বিশ্বাসের ভিত্তিতেই এ চরিত্র গড়ে উঠে। আবার অন্যদিকে রয়েছে আর একটি চরিত্র। কুফরী, জাহেলিয়াত, বৈষয়িক স্বার্থপূজা ও আখেরাতের সাথে সম্পর্কহীনতার ছাঁচে ঢালাই হয়ে এ চরিত্র তৈরী হয়। এখন তোমরা নিজেদের বিবেককে জিজ্ঞেস করো, সে এর মধ্য থেকে কোন চারিত্রিক আদর্শটি পছন্দ করে?

তারপর এ ঘটনা থেকে কুরআন মজীদ আরো একটি গভীর তত্ত্বও মানুষের হৃদয়পটে অংকন করে দেয়। সেটি হচ্ছে, আল্লাহ যে কাজ করতে চান তা যে কোন অবস্থায় সম্পাদিত হয়েই যায়। মানুষ নিজের বুদ্ধিমত্তা ও কলাকৌশলের মাধ্যমে তাঁর পরিকল্পনা প্রতিহত করার বা বদলাবার ব্যাপারে কখনো সফল হতে পারে না। বরং অনেক সময় মানুষ নিজের পরিকল্পনার লক্ষে একটি কাজ করে এবং মনে করতে থাকে যে, সে তীরটি ঠিক নিশানায় মেরে দিয়েছে কিন্তু শেষে প্রমাণ হয় যে, আল্লাহ তারই হাত দিয়ে এমন কাজ করিয়ে নিয়েছেন যা ছিল তার নিজের পরিকল্পনার বিরোধী এবং আল্লাহর পরিকল্পনার পুরোপুরি বাস্তবায়ন। ইউসুফ আলাইহি সালামের ভাইয়েরা যখন তাঁকে কূয়ায় ফেলে দিচ্ছিল তখন তারা মনে করছিলো আমরা নিজেদের পথের কাঁটা চিরতরে দূর করে দিচ্ছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা ইউসুফকে নিজেদের হাতে এমন এক উন্নতির প্রথম ধাপে চড়িয়ে দিয়েছিলো যার ওপর আল্লাহ তাঁকে চড়াতে চাচ্ছিলেন এবং এ কাজ করে তারা নিজেরা যে ফল লাভ করেছে তা এ ছাড়া আর কিছু‌ নয় যে, ইউসুফের উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছে যাবার পর তারা নিজের ভাইয়ের সাথে সসম্মানে সাক্ষাত করতে যাওয়ার পরিবর্তে লজ্জা ও অনুতাপের অনুভূতি সহকারে মাথা নত করে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আযীযে মিসরের স্ত্রী ইউসুফকে কারাগারে পাঠিয়ে মনে করছিল সে প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে তার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পৌঁছার পথ পরিষ্কার করেছিল। আর নিজের এ কৌশলের মাধ্যমে সে নিজের জন্য এর চেয়ে বেশী কিছু অর্জন করতে পারেনি যে, যথার্থ কাজের সময়ে দেশের শাসকের স্ত্রী হিসেবে ‘মুরব্বী’র সম্মান লাভ করার পরিবর্তে তাকে নিজের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য লজ্জায় অধোবদন হতে হয়। এসব নিছক দু’চারটে বিছিন্ন ঘটনা নয়। বরং ইতিহাসের পাতা এমনি ধরনের অসংখ্য ঘটনায় ভরা। এগুলো এ সত্যটিরই সাক্ষ প্রদান করে যে, আল্লাহ যাকে ওপরে উঠাতে চান সারা দুনিয়ার লোকেরা মিলেও তাকে নিচে ফেলে দিতে পারে না। বরং দুনিয়ার লোকেরা তাকে নিচে ফেলে দেয়ার জন্য যে কৌশলটি অত্যন্ত কার্যকর ও নিশ্চিত মনে করে অবলম্বন করে সেই কৌশলের মধ্য দিয়েই আল্লাহ তার ওপরে ওঠার পথ বের করে দেন এবং যারা তাকে নামাতে চেয়েছিল তাদের জন্য লাঞ্ছনা ও অপমান ছাড়া আর কিছুই থাকে না। অনুরূপভাবে এর ঠিক বিপরীতে আল্লাহ যাকে ভূপাতিত করতে চান কোন কৌশলই তাকে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারে না। বরং দাঁড় করিয়ে রাখার যাবতীয় কার্যক্রম ও কৌশল উলটে যায় এবং এ ধরনের কৌশল অবলম্বনকারীকে ব্যর্থ মনোরথ হতে হয়।

যে ব্যক্তি এ সত্যটি উপলব্ধি করবে সে প্রথমে এ শিক্ষা লাভ করবে যে, মানুষকে নিজের উদ্দেশ্য ও কলাকৌশল উভয় ক্ষেত্রে এমন সব সীমারেখা অতিক্রম করা উচিত নয় যা আল্লাহর আইনে তার জন্য নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে। সাফল্য ও ব্যর্থতা অবশ্যি আল্লাহর হাতে। কিন্তু যে ব্যক্তি পবিত্র উদ্দেশ্যে সরল সোজা ও বৈধ কলাকৌশল অবলম্বন করবে সে ব্যর্থ হয়ে গেলেও তাকে লাঞ্ছনা ও অপমানের সম্মুখীন হতে হবে না। আর যে ব্যক্তি অপবিত্র উদ্দেশ্যে বাঁকা কলাকৌশল অবলম্বন করবে সে আখেরাতে তো অবশ্যি অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবেই, দুনিয়াতেও তার জন্য অপমান ও লাঞ্ছনার ভয় কিছু কম নেই। দ্বিতীয়ত সে এ থেকে লাভ করবে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল এবং তাঁর প্রতি আত্মসমর্পিত হবার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। যারা সত্য ও সততার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং দুনিয়াবাসীরা তাদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তারা যদি এ সত্যটি সামনে রাখে তাহলে এ থেকে তারা দুর্লভ মানসিক প্রশান্তি লাভ করবে এবং বিরোধী শক্তিবর্গের বাহ্যত অত্যন্ত ভয়াবহ কলাকৌশলসমূহ দেখে তারা মোটেই ভীত হবে না। বরং ফলাফল আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজেদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকবে।

কিন্তু এ ঘটনাটি থেকে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষটি পাওয়া যায় সেটি হচ্ছে এই যে, একজন মরদে মুমিন যদি সত্যিকার ইসলামী চরিত্রের অধিকারী হয় এবং সে বিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার গুণেও গুণান্বিত হয় তাহলে নিছক নিজের চরিত্র বলে সে সারা দেশ জয় করতে পারে। ইউসুফ আলাইহিস সালামের ব্যাপারটি দেখুন। ১৭ বছর বয়সে একাকী সহায় সম্বলহীন অবস্থায় বিদেশ বিভূঁইয়ে তিনি একেবারেই অপরিচিত পরিবেশে, অধিকন্তু চরম দুর্বল অবস্থায় নিপতিত। কারণ তাঁকে গোলাম বানিয়ে বিক্রি করা হয়। ইতিহাসের সেই অধ্যায়ে গোলামদের যে অবস্থা ছিল তা কারো অজানা নেই। এর ওপর মরার ওপর খাঁড়ার ঘা স্বরূপ একটি মারাত্মক নৈতিক অপরাধে অভিযুক্ত করে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। এখানে শাস্তির কোন মেয়াদ নির্ধারিত হয়নি। এভাবে তাঁকে একেবারে চরম পর্যায়ে নামিয়ে দেবার পরও তিনি নিছক নিজের ঈমান ও চরিত্র বলে উঠে দাঁড়ান এবং শেষ পর্যন্ত সারা দেশের ওপর বিজয়ী হন।

ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক অবস্থা

এ ঘটনাটি সঠিকভাবে বুঝাতে হলে এ সম্পর্কে কিছু সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক তথ্য পাঠকদের সামনে থাকা উচিত।

হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম ছিলেন হযরত ইয়াকূবের (আ) পুত্র, হযরত ইসহাকের পৌত্র এবং হরত ইবরাহীমের প্রপৌত্র। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী (কুরাআনের ইংগিত থেকে এর সমর্থন পাওয়া যায়) হযরত ইয়াকূবের চার স্ত্রী থেকে ছিল বারটি ছেলে। হযরত ইউসুফ (আ) ও বিন ইয়ামীন ছিলেন এক স্ত্রীরর গর্ভজাত এবং বাকি দশজন অন্য স্ত্রীদের গর্ভজাত।

ফিলিস্তিনে হযরত ইয়াকূবের আবার ছিল হিবরূন (বর্তমান আল খাইল) উপত্যকায়। এখানে হযরত ইসহাক (আ) এবং তাঁর পূর্বে হযরত ইবরাহীমও (আ) থাকতেন। এ ছাড়া সিককিমে (বর্তমানে নাবলুস) হযরত ইয়াকূবের (আ) কিছু জমি ছিল।

বাইবেল বিশারদগণের গবেষণাকে সঠিক বলে ধরে নিলে হযরত ইউসুফের জন্ম খৃষ্টপূর্ব ১৯০৬ সালের কাছাকাছি সময়ে হয় বলে ধরা যায়। এ হিসেবে খৃষ্টপূর্ব ১৮৯০ সালের কাছাকাছি সময়ে যে ঘটনাটি ঘটে অর্থাৎ স্বপ্ন দেখা এবং কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হওয়া, এ থেকে এ ঘটনাটির সূত্রপাত্র হয়। এ সময় হযরত ইউসুফের বয়স ছিল ১৭ বছর। যে কূয়ায় তাঁকে ফেলে দেয়া হয় সেটি বাইবেল ও তালমূদের ভাষ্যমতে সিককিমের উত্তর দিকে দূতান (বর্তমানে দূসান) নামক স্থানে কাছাকাছি অবস্থিত ছিল। আর যে কাফেলাটি তাঁকে কূয়া থেকে উদ্ধার করে তারা জাল’আদ (পূর্ব জর্দান) থেকে আসছিল এবং মিসরের দিকে যাচ্ছিল। (জাল’আদের ধ্বংসাবশেষ আজো জর্দান নদীর পূর্ব দিকে ইলিয়াবিস উপত্যকার কিনারে পাওয়া যায়।

এ সময় মিসরে পঞ্চদশতম রাজ পরিবারের শাসন চলছিল। মিসরের ইতিহাসে এ পরিবারটি রাখাল রাজন্যবর্গ (HYKSOS KINGS) নামে পরিচিত। এরা ছিল আরবীয় বংশজাত। খৃষ্টপূর্ব দু’হাজার বছরের কাছাকাছি সময়ে এরা ফিলিস্তিন ও সিরিয়া থেকে মিসরে গিয়ে দেশের শাসন কর্তৃত্ব দখল করেছিল। আরব ঐতিহাসিক ও কুরআনের তাফসীরকারগণ তাদের জন্য “আমালীক” নাম ব্যবহার করেছেন। মিসর সম্পর্কীয় আধুনিক অনুসন্ধান ও গবেষণার সাথে এটি পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। মিসরে এরা বিদেশী হানাদারের পর্যায়ভুক্ত ছিল এবং দেশে গৃহবিবাদের কারণে তারা যেখানে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। এ কারণে তাদের রাজত্বে হযরত ইউসুফের (আ) উত্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল এবং তারা বনী ইসরাঈলকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। হযরত ইউসুফ (আ)-এর কাহিনী সংক্রান্ত মানচিত্র

মানচিত্র ()

দুতনঃ বাইবেলের মতে এ স্থানেই হযরত ইউসুফ কূপে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল।

সিক্কিমঃ এখানে হযরত ইয়াকূবের পৈতৃক সম্পত্তি ছিল। বর্তমানে এর নাম নাবলূস।

হিবরুনঃ এখানে হযরত ইয়াকূব বসবাস করতেন। এর আর এক নাম ‘আল-খলীল।’

জুশানঃ হযরত ইউসুফ এখানে বনী ইরাঈলদেরকে পুনর্বাসিত করেন।

সবচেয়ে উর্বর এলাকা তাদের বসতি স্থাপন করার জন্য দেয়া হয়েছিল। সেখানে তারা বিপুল প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী হয়েছিল। কারণ তারা ছিল বিদেশী শাসকদের সগোত্রীয়। খৃষ্টপূর্ব পঞ্চদশ শতকের শেষ অবধি তারা মিসর শাসন করতে থাকে। তাদের আমলে কার্যত দেশের যাবতীয় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বনী ইসরাঈলের হাতে ন্যস্ত থাকে। সূরা ময়েদার ২০ আয়াতে এ যুগের প্রতি ইংগিত করে বলা হয়েছেঃ

(আরবী)

এরপর দেশে একটি প্রবল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সৃষ্টি হয়। এর ফলে হিক্‌সুস (HYKSOS) শাসনের অবসান ঘটে। আড়াই লাখের মতো আমালিকাকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়। একটি চরম বিদ্বেষী কিব্‌তী বংশোদ্ভূত পরিবার দেশের শাসন কর্তৃত্ব দখল করে। তারা আমালিকাদের আমলের প্রত্যেকটি স্মৃতি চিহ্ন খুঁজে খুঁজে বের করে এনে ধ্বংস করে দেয় এবং হযরত মূসার (আ) ঘটনা প্রসংগে বনী ইসরাঈলদের প্রতি যেসব অত্যাচারের কাহিনী উল্লেখিত হয়েছে তার ধারাবাহিকতার সূত্রপাত করে।

মিসরের ইতিহাস থেকে একথাও জানা যায় যে, এ রাখাল বাদশাহরা মিসরীয় দেবতাদেরকে স্বীকৃতি দেয়নি। তারা সিরিয়া থেকে নিজেদের দেবতা সংগে করে এসেছিল। মিসরে নিজেদের ধর্মের প্রসারে তারা প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। এ করণে কুরআন মজীদ হযরত ইসুফের সমকালীন মিসর সম্রাটকে “ফেরাউন” নামে উল্লেখ করছে না। কারণ ফেরাউন ছিল মিসরের ধর্মীয় পরিভাষা এবং এরা মিসরীয় ধর্মের প্রবক্তা ছিল না। কিন্তু বাইবেলে ভুলক্রমে তাকেও “ফেরাউন” বলা হয়েছে। সম্ভবত বাইবেল সংকলকগণ মনে করতেন যে, মিসরের সব বাদশাহই “ফেরাউন” ছিল।

বর্তমান যুগের অনুসন্ধানী ও গবেষকগণ বাইবেল ও মিসরীয় ইতিহাসের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করছেন। তারা সাধারণভাবে এ অভিমত পোষণ করেন যে, মিসরের ইতিহাসে রাখাল বাদশাহদের মধ্যে আপোফিস (APOPHIS) নাকম বাদশাহই ছিলেন হযরত ইউসুফের সমসাময়িক।

এ সয়ম মমফিস (মনফ) ছিল মিসরের রাজধানী। কায়রোর দক্ষিণে ১৪ মাইল দূরে এর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। হযরত ইউসুফ (আ) ১৭/১৮ বছর বয়সে সেখানে পৌঁছেন। দু’তিন বছর আযীযে মিসরের বাড়িতে থাকেন। আট নয় বছর কারাগারে বাস করেন। ৩০ বছর বয়সে দেশের শাসক নিযুক্ত হন। ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত একচ্ছত্রভাবে সমগ্র মিসর শাসন করতে থাকেন। তাঁর শাসনকালের নবম বা দশম বছরে তিনি হযরত ইয়কূবকে (আ) তাঁর সমগ্র পরিবার পরিজনসহ ফিলিস্তিন থেকে মিসরে নিয়ে আসেন। তাদেরকে দিমীয়াত ও কায়রোর মাঝামাঝি এলাকায় আবাদ করেন। বাইবেলে এ এলাকার নাম জুশান বা গুশান বলা হয়েছে। হযরত মূসার (আ) আমল পর্যন্ত তারা সেখানেই বসবাস করতো। বাইবেলের বর্ণনামতে হযরত ইউসুফ একশো দশ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুকালে তিনি বনী ইসরাঈলকে অসিয়াত করে যান, তোমরা যখন এ দেশ ত্যাগ করবে তখন আমার হাড়গুলো সংগে করে নিয়ে যাবে।

বাইবেলে ও তালমূদে ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনার যে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে কুরআনের বর্ণনা তা থেকে অনেকটা ভিন্নতর। কিন্তু ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ অংশে তিনটি বর্ণনাই একাত্ম । আমার ব্যাখ্যা ও টীকাগুলোতে আমি প্রয়োজনমতো এ পার্থক্য সুস্পষ্ট করে যেতে থাকবো।